Friday, March 30, 2012

অসতী দাহ

এটি একটি আরব মেয়ের গল্প। শুধু আরব নয় মুসলমান আরব।
একটা সিঙাড়া আর এক কাপ চা নিয়ে আরাম করে বসুন। গল্পটা খুব আরামের নয়। মেয়েটির নাম সোয়াদ। আগেপিছে কিছু নেই, শুধুই সোয়াদ। পারিবারিক নাম আছে একটা, কিন্তু ওটা সে ব্যবহার করেনা, পাছে কোন বিপদ হয়। পৈতৃক পরিচয় বহন করবার অধিকার তার নেই। তার বাবা-মা জানে না যে সে বেঁচে আছে। জানলে হয়তো তাকে দ্বিতীয়বার মরতে হবে!

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে প্যালেস্টাইনের একটি ছোট্ট গ্রামে এ গল্পের শুরু। সোয়াদরা চার বোন, এক ভাই। ছোট দুটি সৎ বোনও আছে তার, বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। ওর মায়ের বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে। প্যালেস্টানের মেয়েদের ওটাই হলো বিয়ের বয়স। তার বেশী হয়ে গেলে গ্রামের লোকের কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। কড়াকড়ি পর্দাপ্রথা না থাকলেও মেয়েদের নিষেধাজ্ঞাগুলো পর্দার চেয়ে কম নয়। মাথা নিচু করে হাঁটবে, প্রসাধন করে বের হবে না, কোন পুরুষের দিকে তাকাবে না, পুরুষের সাথে কথা বলবে না। এক মায়ের পেটের ভাই ছাড়া আর কোন যুবকের সাথে চোখাচুখি হলে সবাই চার্মুটা বলে গাল দিতে শুরু করে। চার্মুটা অর্থ হল খারাপ মেয়ে, বেশ্যা। আসলে সমাজের নিয়মটাই এই যে পরপুরুষের দিকে মেয়েদের চোখ পড়ার মুহূর্ত থেকেই তার পাত্র খোঁজা শুরু করতে হবে।
বিয়ের পর মেয়েদের তিনটি কর্তব্য। এক, অন্তত একটি পুত্র সন্তান প্রসব করতে হবে। দুই, দুইটি কি বড়জোর তিনটি কন্যাসন্তান, যাতে ঘরের কাজে, গরু-ছাগল আর ক্ষেত-খামারের কাজে সাহায্য করতে পারে। তিন, পরিবারের জন্য তিন বেলা খাবারদাবারের ব্যবস্থা। এর কোনটিতে সামান্য ব্যতিক্রম হলে তার শাস্তি আছে। সোয়াদ নিজে তার মাকে বহুবার বাবার হাতে পিটুনি খেতে দেখেছে। চুলের মুঠি ধরে কাবু করার পর শক্ত মার দেয়া হলো আবর-পুরুষদের একটি বৈশিষ্ট্য। আসলে মেয়েদের চুলের প্রতি গোটা আবরজাতির যেন একটা বিশেষ আর্কষণ। শুধু পুরুষ নয়, মেয়েরাও ঝগড়াঝাটি করতে চাইলে চুলের দিকেই তাক করে প্রথমে।
বলা বাহুল্য যে গ্রামে মেয়েদের স্কুলে পাঠানো হয়না, সেখানে মেয়েরা কাজ করে ঘরে। স্কুলে যায় ছেলেরা। সন্ধ্যাবেলা সবাই বাড়ি এলে বাইরের গেট বন্ধ হয়ে যায়। সোয়াদের বাবা আর ভাই আসাদ প্রায়ই বাইরে গিয়ে ফুর্তি করে, সিনেমা দেখে। মেয়েদের জন্য এগুলো হারাম। উপরন্তু ঘরের কাজে একটু উনিশ-বিশ হলে বাবা রেগে আগুন হয়। একদিন তার বড়বোন কৈনাত আর তাকে একসাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে অসম্ভব মার মেরেছিল, কারণ ভেড়াগুলো ওদের পাহারায় না থেকে নিজেরাই ফিরে এসেছিল খোঁয়াড়ে। মেয়েদের ওপর অনর্থক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার মা এসে বাঁধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে মাকেও মার খেতে হয়েছিল। কৈনাতের বিয়ের পর তার স্বামীও তার ওপর মারধোর শুরু করল। বেচারীর চুপ করে সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিলনা। প্যালেস্টাইনের মেয়েরা স্বামীর অত্যাচারে কেঁদে কেঁদে বাপারে বাড়ি ফিরে আসতে পারে না। ওতে পরিবারের লজ্জা। লোকে মন্দ বলবে। একবার ওর এক বড়বোন বলেছিল মার নাকি চৌদ্দটি সন্তান ছিল। তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি বেঁচে আছে, বাকিরা নেই কেন সে প্রশ্নটি তাকে মনে মনে খোঁচায়নি তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন করতে সে সাহস পায়নি। একদিন নিজেই সে প্রমাণ পেয়ে যায়।
সোয়াদের বয়স তখন দশের নিচে। বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরে দেখে তার মা মেঝের ওপর পাতা বিছানায় শুয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। তার খালা সালিমা পাশে বসে এটাওটা করছেন। কিছুক্ষণ পরে সন্তান ভূমিষ্ট হলো। বাচ্চাটাকে খালা হাতে ঝুলন্ত অবস্থায় ধরে আছেন। বাচ্চাটি তখন কাঁদছিল। মা তাকে এক নজর দেখলেন। তারপর বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মেঝেতে ছড়ানো ভেড়ার চামড়াতে মুড়ে বাচ্চাটিকে চেপে ধরলেন শক্ত করে। বাচ্চাটির কান্না থেমে গেল! দশ বছরের খুকী হয়েও সোয়াদের বুঝতে বাকি রইল না কেন চৌদ্দটি বাচ্চার মধ্যে এখন পাঁচটি টিকে আছে। সোয়াদের শরীর থরথর করে কাঁপছে তখন, কিন্তু নোরা নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি, দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সে ফিসফিস করে বলল সোয়াদকে- আমার যদি মেয়ে হয় আমিও ঠিক এই করব।

বাবা মা বা গ্রামের মুরব্বিদের নিষ্ঠুরতায় কোনদিন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি সোয়াদ। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হত এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। সে দা-কুড়াল দেখলে ভয় পায়, বাবার মুরগি কাটা বা ভেড়া কাটা দেখেলে তার রক্ত হিম হয়ে যেত, সে মই বেয়ে উপরে উঠতে ভয় পেত, বিশেষ করে তার বাবা সে মই ধরে নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে। সবচেয়ে বেশী ভয় পেত সে বাড়ির কুয়োটাকে। কূয়োর পানিতে পড়ে মরার আতঙ্ক একটা বাতিক হয়ে দাড়িয়েছিল ওর। কল্পনা করত একদিন বাড়ি ফিরে দেখবে তার বাবা মাকে কূয়াতে ফেলে দিয়েছে। মায়ের মৃত্যুকে দারুণ ভয় পেত সে। কারণ আর যাই হোক মাই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়।
হেনা নামে একটা বোন ছিল তার। ভীষন সুন্দর দেখতে। চরিত্র স্বাভাবেও সে ছিল অন্য সবার থেকে ভিন্ন। খেয়ালী, স্বাপ্নিক, ভাবাবিষ্ট। কেউ তাকে কিছু বললে যেন কানে যেত না ওর। কাজেকর্মে মন ছিলনা। সবকিছুতেই ঢিলামি। তার চালচলন ছিল বড়লোকের সৌখিন মেয়েদের মতো। ওর কপালে যে দুঃখ ছিল সেটা সবাই জানত। একদিন বাড়িতে চিৎকার চেচামিচি শুনে সোয়াদ আর তার বোনগুলো দৌড়ে গেল কি হয়েছে দেখতে। গিয়ে দেখে হেনা মাটিতে পরে গলাকাটা ভেড়ার মতো দাপড়াচ্ছে, হাত,পা,মুখ শক্ত করে বাঁধা। ভাই আসাদ তার গায়ের ওপর বসে গলায় ফাঁসি দিয়ে মারবার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেনার আমলকীর আঁশের মতো নরম আদুরে মুখটা নীল হয়ে উঠল। জিভ বেড়িয়ে এলো গলা থেকে, যেন ওটাই প্রতিবাদের একমাত্র অন্ত্র। কি অপরাধ করেছিল হেনা তা কোনদিন জানতে পারেনি সোয়াদ। জানতে চাওয়ার সাহস ছিলনা। প্যালেস্টাইনের গ্রাম্য মেয়েরা জীবন হারায় কেবল যৌবনের অপরাধে। আরবজাতির মুসলমান ঘরে পারিবারিক সম্মানের চাইতে মূল্যবান জিনিস আর নেই। আর সেই সম্মান রাখা না রাখার পুরো দায়িত্বটাই মেয়েদের। আসাদের মহান কর্তব্যটি সংঘটিত হবার কালে বাবা মা দুজনেই ছিল বাড়ির বাইরে। ফিরে এসে এ ঘটনা দেখে আসাদের সাথে কি কথা বলাবলি করার পরই মা যথারীতি কাঁদতে শুরু করলেন। যথারীতি কারণ এমন নাটক আরো দেখেছে সোয়াদ। কোন অপরাধ করা হলে প্রথমে পারিবারিক সালিশে সিদ্ধান্ত নেয় হয় কি শাস্তি দেয়া হবে। বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক হলে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়ে লঘু অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মেয়েদের। আর শাস্তিটি কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হয় পরিবারের কোন না কোন সদস্যর ওপর। আর যার ওপর দায়িত্বটি দেয়া হয় তিনি হলেন ভাগ্যবান। কারণ কাজটি মহৎ, এতে পূণ্য আছে। দণ্ডের কার্য দিবসে বাবা মা কোন এক ছুতোয় বাইরে চলে যান। কর্মসিদ্ধির পর ফিরে এসে সোয়াদের মায়ের মতো নাকিকান্না জুড়ে দেন। এই হল সামাজের ধারা। পারিবারিক সম্মান-রক্ষার মধ্যযুগীয় পন্থা।
দেখতে দেখতে সোয়াদের বয়স আঠারো হয়। বিয়ের নাম গন্ধ নেই। পাশের বাড়ির একটি ছেলে, ফৈয়াজ তার নাম, তার দিকে নজর দিতে শুরু করেছে। সেটা সে টের পায়। ছাদের উপর কাপড় শুকাতে গেলে তার সাথে চোখাচোখি হয়। সোয়াদের বুক কেঁপে ওঠে, ভয়ে, লজ্জায়, ভালো লাগায়। তার নারী মন বুঝতে পারে ফৈয়াজ তাকে পেতে চায়। ছেলেটি গ্রামের অন্য ছেলেদের মতো নয়। স্যুট-কোট পরে, গাড়ি চালায়। নিশ্চয়ই শহরে কোন বড় চাকরী করে। শহর কেমন, গাড়ি চড়তে কেমন লাগে! এসব আকাশকুসুম কল্পনা সোয়াদের মনে। কিন্তু পোড়া কপাল। তার যে একটা বড় বোন আছে যার এখনো বিয়ে হয়নি। বিয়ের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছেনা। পাত্রের বাবা-মা তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু সোয়াদের কি হবে? বড় বোনের বিয়ে না হলে কি তারও বিয়ে হবে না?

চকিত লাজের আঁখি বিনিময় ধীরে ধীরে অন্যদিকে মোড় নেয়। হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে সচেতন হয়ে পড়ে দুজনেই। লজ্জায় মরে যায় সোয়াদ, যেন হাটু ভেঙ্গে গেছে আর এক পাও চলতে পারবেনা সে। একদিন মহাবিস্মিত কানে ফৈয়াজের গলার আওয়াজ শুনতে পায়- খোয়াড়ের পেছনে জলপাই গাছটার নিচে, এশার নামাজের সময়। ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হয়না। একবার ভাবে, যাবে না। লোকটা ভেবেছে কি? এতই সস্তা? ইশারা দিলেই বেহায়ার মতো গিয়ে বসবে তার কোলে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায় সোয়াদ। দম নেবার চেষ্টা করে। না, যাবে না। বিপদজ্জনক। হেনার কথা ভোলেনি। ধরা পড়লে তো সব শেষ। পরের দিনই সালিশ বসবে। হয়তো আসাদের ওপরই দায়িত্ব পড়বে সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় সোয়াদের। দিনটা কাটে দারুণ অস্থিরতায়। এক মন বলে, যেও না। আরেক মন বলে, এই তোমার শেষ সুযোগ। এমন ছেলে হাজারে একটা মেলে না। কে তোমাকে রাণী সাজিয়ে নিজের গাড়িতে করে শহরে নিয়ে যাবে? সন্ধ্যা বেলা ভালো করে খেতেও পারেনা মেয়েটা। গায়ের রক্ত ঘোড়ার মতো ছুটছে। এশার নামাজে চলে যায় তার বাবা আর ভাই। শৌচাগারে যাবার নাম করে বেরিয়ে পরে ঘর থেকে। ফৈয়াজ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করেছিল ওর জন্য। কাছে যেতেই কোন শব্দ উচ্চারণ না করেই ওকে জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করল। বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল সে। কোন পুরুষের ছোঁয়া আজ পর্যন্ত তার গায়ে লাগেনি। ফৈয়াজ দমবার পাত্র নয়। তার একটা হাত চলে গেলে সোয়াদের উরুতে, সেখান থেকে আস্তে আস্তে তার পশ্চাতদেশে, যেখানে ভাগীরথীর প্রবল বন্যা আছড়ে পড়েছে মহাসাগরের জলে। সে আরও কুঁচকে উঠল। আতঙ্কে, তৃষ্ণায়। যৌবন তো তার দেহেও ক্ষুধার ফসল বুনেছিল। তারও তো ছিল মধুমালঞ্জের শাখায় বসে অমৃতের আস্বাদ পাবার সাধ। কিন্তু সে হেনার আর্তনাদ শুনেছে, শুনেছে আরও অনেক নৃশংস কাহিনী। ফৈয়াজকে জানায় তার ভয়ের কথা। ফৈয়াজ তার গা ছুঁয়ে আশ্বাস দেয়, ও তাকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়, তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে, ওকে ছাড়া তার জীবন বৃথা, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফৈয়াজের গলায় আন্তরিকতার অভাব দেখেনা সোয়াদ। বিয়েই যখন হবে তাহলে আর আপত্তি কেন। প্রেমিকের ডুবরী হাতটিকে সে আর ঠেলবার চেষ্টা করেনা। এভাবেই কিছুদিন চলে তাদের নৈশ অভিসার।
খবরটা ফৈয়াজ কে দেবার সাথে সাথে ওর মুখটা সাদা হয়ে গেল। যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল সে। অনেকণ চুপ থাকার পর যেন কথা খুঁজে পেল। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু চিন্তা করো না প্রিয়া, আমার ওপর সব ছেড়ে দাও। তোমার বাবার সাথে কথা বলব। আমার ইশারার অপেক্ষা করো তুমি। তার আগে কাউকে কিছু বলবে না। কাউকে কিছু বলেনি সোয়াদ। ফৈয়াজের ইশারার অপেক্ষা করতে থাকে। এছাড়া উপায়ই বা কি। একদিন, দুইদিন। দু’সপ্তাহ। দু’মাস। ইশারা আসেনা। ইতিমধ্যে পেট ফুলতে শুরু করেছে। সেটা অন্য কারো নজরে পড়বার আগেই সাক্ষাৎ যমের চোখে পড়ে যায়। বাবা একদিন তার সামনে এসে দাঁড়ায়, রণমুর্তিতে। বেতের লাঠিটা মাটিতে সজোরে আঘাত করে বলে- তোর পেটে বাচ্চা! অস্বীকার করে সে। মাকে গিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে যে তার ঋতুস্রাবে অনিয়ম ঘটেনি। কিন্তু সে নিজেও বোঝে এটা কারো কানে যাচ্ছেনা। ওদিকে ফৈয়াজের ইশারাও যেন কোথায় দিশা হারিয়ে ফেলেছে।

রীতি অনুযায়ী বাড়িতে বৈঠক বসে একদিন। বাবা-মা, বড়বোন নোরা ও তার স্বামী হুসেন। শাস্তির ব্যাপারে কারো মতভেদ ছিল না, প্রশ্ন দাঁড়াল কে সেটাকে কার্যকর করবে। বাবার প্রস্তাব, আসাদ। কিন্তু মা আপত্তি জানালেন। আসাদ এখনো কচি ছেলে, ও পারবে না। মা হয়তো ভুলে গেছে যে হেনার গলায় ফাঁসি দেবার সময় তার ছেলেটি তেমন কচি ছিল না। ঠিক আছে আসাদ না হলে আমিই করব, সোৎসাহে বলে উঠল হুসেন, সোয়াদের দুলাভাই। পাশের ঘরে বসে সব শুনছে সে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলনা যে বৈঠকটা তাকেই কেন্দ্র করে, এবং শাস্তির বিধান ওরই জন্য। এটা কি স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন? ওর বাবা হুসেনের প্রস্তাব মেনে নেয়, ঠিক আছে তুমি যদি ভার নিতে চাও, নাও। দেখো কোন গন্ডগোল যেন বাধিয়ে না ফেলো। কোন গণ্ডগোলই লাগবে না আব্বাজী, আপনি নিশ্চিত থাকুন। আমার মাথায় যে বুদ্ধিটা আছে তা একেবারেই মোম। জবাব দেয় তারই আপন বোনের স্বামী।
যথারীতি তার বাবা-মা একদিন কি এক জরুরী কাজে শহরে চলে গেল। সোয়াদ বুঝল এটাই তার জীবনের শেষ দিন। ডে অফ এক্সিকিউশন। কোনো কোর্ট-কাচারী নেই, আপিল-আদালত নেই, পরিবারের রায়ই চুড়ান্ত রায়। যথাসময়ে দুলাভাই হাজির হল বাড়িতে। হাসিমুখ। হাজার হলেও দুলাভাই তো! হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক। মুশকিল এই যে সোয়াদের মনের অবস্থাটা তখন ঠিক হাসবার মতো ছিল না। বারান্দার একধারে বড় একটা পাথরের ওপর বসে দু’হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে থাকল। এক কোপে গর্দান কেটে ফেললে মন্দ হয় না-ভোগান্তিটা কম। কিন্তু কম ভোগান্তির কপাল ছিল না সোয়াদের। কিছুক্ষণ পর ঘাড়ের পেছন দিকটায় কি একটা তরল জিনিস অনুভব করল সোয়াদ। চোখের পলক না ফেলতেই বুঝতে পারল তার পিঠে আগুন লেগেছে, এবং সে আগুন দাউ দাউ করে ছুটে আসছে তার সামনের দিকে। পোড়া চামড়ার গন্ধ নাকে নিয়ে সে পাগলের মতো ছুটল দেয়ালের দিকে। কেমন করে যে সে দেয়াল টপকে রাস্তায় নেমে গেল কিছুই মনে নেই। তার জ্বলন্ত শরীর দেখে দুজন ভদ্রমহিলা এসে আগুন নেভাতে চেষ্টা করলেন তাদের চাদর দিয়ে। কলতলায় নিয়ে ওর গায়ে পানি ঢাললেন কয়েক বালতি। পানির ছোঁয়া পেয়ে তার গায়ের পোড়াটা যেন আরও তেতে উঠল। আহারে বেচারী, কি কষ্ট বেচারীর, বলে স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করলেন দয়াশীল মহিলা দু’টি। তখনো চৈতন্য ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল গায়ের চামড়া ছিঁড়ে ফেলে দেয়, তাতে যদি যন্ত্রণা কমে। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।
অমানবিক ব্যাথা নিয়ে যখন সে জেগে ওঠে ঘুমের ঘোর থেকে, দেখে, সে একটা নরম বিছানায় শুয়ে আছে। তার দু’পাশে অচেনা লোকজন, কেউ ডাক্তার, কেউ নার্স, কেউবা আর্দালি। সে জীবিত না মৃত বুঝতে পারছিলনা। আগুন তার উরু থেকে মাথা পর্যন্ত সবটুকু জায়গাই গ্রাস করে ফেলেছিল। তার হাত দুটো শক্ত কাঠির মতো দু’পাশে ঝুলছে, কোনরকম বোধশক্তি ছিল না ওগুলোতে। বুক আর চিবুকের চামড়া গলে গিয়ে জোড়া লেগে গিয়েছিল একসাথে। ফলে সে মাথা তুলতে পারছিলনা। আধো ঘুম আধো জাগরণে একটা মানুষের মূর্তি ভেসে ওঠে তার সামনে। মূর্তিটা কোন এক মহিলার। নার্স হতে পারেনা, কারণ নার্স কখনো রোগীর ঘরে এসে চেয়ারে বসে আরাম করে না। মহিলাটি চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। কান্না কান্না ভাব যেন। তার মা না এটা! হ্যাঁ, মা -ই তো বটে। মা এসেছে ওকে দেখতে? সে কি করে সম্ভব? আরব কালচারে তো ওরকম কোনো রীতি নেই। মা কিছু বলল না ওকে। হাতে একটা বোতল ছিল। নিশ্চয়ই পানির বোতল হবে। ভীষণ পানি পিপাসা পায় ওর। মা একটা গ্লাসে করে ওকে পানি এগিয়ে দেয়। সে পানি খাবার জন্য মুখ বাড়াবার চেষ্টা করে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন তরুন ডাক্তার এসে ঘরে ঢোকে। ওর মুখ থেকে গ্লাসটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। ওই ফাঁকে মা আলগোছে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অল্পের জন্য বেঁচে গেলে, আমি আর একটু পরে এলে তোমাকে আর পাওয়া যেতনা,বলে ডাক্তারটি। ডাক্তারও প্যালেস্টাইনের মুসলমান ছেলে। রীতিনীতি জানে। এ ও জানে যে রীতিনীতি শুধু পরিবারের লোকজনের জন্যই নয়, হাসপাতালের নার্স ডাক্তার, পুলিশ উকিল, জজ-ম্যাজিস্ট্রেট সবার বেলাতেই প্রযোজ্য। হয়তো তার মনে মায়া দয়া ছিল বলেই তার সামনে একটি হত্যাকান্ড ঘটবে তা তার সহ্য হয়নি।

পরের দিন একটা তীব্র ব্যাথা বোধ করল তার তলপেটে। পোড়া চামড়ার ব্যাথা নয় ওটা, অন্যরকম ব্যাথা। নার্স এসে বলল ওটা তার প্রসব-বেদনা! বাচ্চা এসে যাচ্ছে। গর্ভধারণের মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই। সে আশা করেনি বাচ্চা বাঁচবে। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত ঝড়-ঝাপটার পরেও বাচ্চাটি মোটামুটি সুস্থই ছিল। নাম রাখা হলো মারোয়ান। ছেলে, ভাগ্যিস। নইলে হয়তো ওটাকেও কেউ গলা টিপে মেরে ফেলত। কিন্তু বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করবার উপায় ছিলনা। এমন কি ওকে এক নজর দেখতেও দেয়নি। ঝটপট হাসপাতাল থেকে বের করে কোনো এক এতিমখানায় রেখে এসেছিল, ওর অনুমতি ছাড়াই। অসতী মেয়েদের আবার অনুমতি কিসের?
এর তিনদিন পর জ্যাকেলিন নামের এক ইউরোপিয়ান ভদ্রমহিলা এসে ওর পাশে দাঁড়ালেন। গম্ভীর অথচ খুব মোলায়েম কন্ঠে বললেন- আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। বুঝতে পারছ কি বলছি? পোড়া ঘায়ের ব্যাথায় বধির হয়ে গেলেও সোয়াদ শুনতে পেল ঠিকই, কিন্তু কষ্ট হলো বিশ্বাস করতে। সে তো পরিবারের সম্মান নষ্ট করেছে। হাসপাতালের বিছানাটা লক্ষ কোটি সূঁচের মতো লেগে আছ তার শরীরে। সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। তাকে সাহায্য করা সম্ভব কারো পক্ষে? সে চারদিন ধরে কোন খাবার মুখে দেয়নি। খেতে পারেনা বলে নয়, কেউ খেতে দেয়না বলে। হাসপাতালের ডাক্তার নার্স কেউ আশা করেনা সে বাঁচবে। সুতরাং অনর্থক খাবার নষ্ট করে লাভ কি। এ সব সে মোটামুটি বোঝে। এ সমাজে পতিতা মেয়েদের কেউ বাঁচাবার চেষ্টা করে না, কারণ পতিতার ত্রাণকর্তাকেও প্রতিফলে পতনের সম্মুখীন হতে হয়। এত সব জেনেও তার মনে একটা ক্ষীণ আশার আলো জেগে ওঠে। অতি কষ্টে পোড়া ঠোঁট দুটো নাড়াবার চেষ্টা করে সে বলে, আচ্ছা।

তারপর কোথা থেকে কি হয়ে গেল তার মনে নেই। যেন একটা লম্বা ঘুম। ঘুম ভাঙ্গবার পর সে দেখে সে একটা বিমানের ভেতর পাতা বিছানায় শুয়ে আছে। পাশের একটা ছোট্ট ক্যারাজে তার কোলের শিশু মারোয়ান। এটা কি সত্যি সত্যি ঘটছে, নাকি স্বপ্নের ঘোর! কিছুক্ষণ পর জ্যাকেলিন তার পাশে এসে বসলেন যেমন করে রুগ্ন কন্যার পাশে মায়েরা বসেন। তেমনি স্নিগ্ধ মায়াময় মুখ, স্বগীয় সুধায় ভরা হাসি। বললেন- আর ভয় নেই তোমার। তোমাকে আমরা নতুন জীবন দেব। ঘটনা পরিক্রমা সব খুলে বললেন তিনি। হাসপাতালের কতৃপক্ষ পিতা-মাতাকে আশ্বাস দিয়েছিল একটি সুইস মানবকল্যাণ সংস্থা, যার একজন স্বেচ্ছাসেবক হলেন এই দয়ার সাগর এই মহিলাটি। তিনি সোয়াদ কে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছেন তার অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে একটু সহজ করার জন্য। ওর বাবা মাকে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে যদি কোনোক্রমে বেঁচেও যায় সে, তার মুখ কোনোদিন দেখতে হবেনা তাদের। তার নামও যেন উচ্চারণ করা না হয় তাদের কাছে। শহরের বিভিন্ন এতিমখানায় খোঁজ নিয়ে তারা বের করেছে সোয়াদের অবাঞ্ছিত জারজ সন্তানকে। সোয়াদ বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে মহিলাটির দিকে। ওরা কি একই পৃথিবীর মানুষ!
সুইজারলেন্ডের সবচেয়ে নামকরা চামড়া হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে সোয়াদের চিকিৎসা চলে। সুক্ষ জটিল অস্ত্রোপচারের সাহায্যে ওর বুকের চামড়া থেকে চিবুক ছাড়ানো হয়। দুই হাতে বোধশক্তি ফিরে আসে। আস্তে আস্তে এক’পা দু’পা করে হাঁটতেও শুরু করে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথম দু’বছর সে একটি পরিবারের সাথে বসবাস করে। এই পরিবারটিই মারোয়ানকে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তারাই মারোয়ানের বাবা-মা। কালক্রমে তারা সোয়াদেরও বাবা-মা হয়ে ওঠে। চব্বিশ বছর বয়সে সে নিজের পথে বেড়িয়ে পরার সিদ্ধান্ত নেয়। লেখাপড়া শেখে, ছোটখাট চাকরি নেয়। এমনকি অ্যান্টনিও নামক একটি অসম্ভব ভালো ছেলে তার প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ করলে সে সানন্দে তার প্রস্তাব গ্রহণ করে। এখন সে মুক্ত পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে অতি সুখের জীবন যাপন করছে তার স্ত্রী-অন্ত:প্রাণ স্বামী ও দুটি কন্যার সাথে। সে তার মুসলিম পরিচয় এখনো বর্জন করেনি, করবেও না। কিন্তু আরব বর্বরতার স্মৃতি তার মনকে কুঁকড়ে দেয় অহর্নিশি।

No comments:

Post a Comment